মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে গত ফেব্রুয়ারিতে একটি ফোন কলে অনুরোধ করেছিলেন, যাতে মস্কো যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে পারে। আলোচনার মূল বিষয় ছিল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধী বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতি তেহরানের সমর্থন। রাশিয়া এই প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছে বলে ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের এই পদক্ষেপকে বিশেষজ্ঞরা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন। কারণ তার প্রথম মেয়াদে তিনি ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন এবং ২০১৮ সালে একতরফাভাবে ইরানের পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। তবে এবার তিনি সামরিক উত্তেজনা এড়িয়ে ইরানের সঙ্গে নতুন কোনো চুক্তির সম্ভাবনা খুঁজছেন।
এদিকে, রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে সম্প্রতি ঘনিষ্ঠ কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাই মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মস্কোকে বেছে নেওয়া একপ্রকার কৌশলগত হিসাব-নিকাশের অংশ বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সৌদি আরবে আলোচনা
ট্রাম্প-পুতিন ফোনালাপের কয়েকদিন পর মধ্য ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়। ওই বৈঠকে অংশ নেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ওয়াল্টজ, বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ, রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ, রুশ পররাষ্ট্রনীতি উপদেষ্টা ইউরি উশাকভ এবং রাশিয়ার সার্বভৌম সম্পদ তহবিলের প্রধান কিরিল দিমিত্রিয়েভ।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ ব্লুমবার্গকে বলেন, রাশিয়া বিশ্বাস করে যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান আলোচনার মাধ্যমে তাদের সমস্যার সমাধান করবে, এবং মস্কো এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
নাম প্রকাশ না করে হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা ব্লুমবার্গকে জানান, রাশিয়া নিজ উদ্যোগেই এই মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেয়, যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়াকে এই ভূমিকা পালন করতে বলেনি।
ইরানের প্রতিক্রিয়া
সোমবার এক টেলিভিশন সংবাদ সম্মেলনে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বাকাই বলেন, এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অনেক পক্ষই সহযোগিতা করতে চায়। পরিস্থিতির জটিলতা দূর করতে বিভিন্ন দেশ যদি সহায়তার প্রস্তাব দেয়, তা স্বাভাবিক।
রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতের চেষ্টা
এই ঘটনাকে বিশেষজ্ঞরা ট্রাম্পের রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন। ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে গিয়েছিল।
ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন
দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিতে রাশিয়া ও ইরানের প্রতি নরম মনোভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইউক্রেনকে বাদ দিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করা এবং সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ট্রাম্পের প্রকাশ্য বিরোধ পরিস্থিতির পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের বিরুদ্ধে আবারও সর্বোচ্চ চাপ নীতি বাস্তবায়ন করছে, যা তার প্রথম মেয়াদে ছিল। তবে এবার ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করতে ইচ্ছুক এবং যেকোনো সামরিক সংঘাতের চেয়ে কূটনৈতিক সমাধানকে অগ্রাধিকার দিতে চান।
২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের পরমাণু চুক্তি (জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন) থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে একতরফাভাবে সরিয়ে নেয়। এরপর ইরানও চুক্তির শর্ত মানতে অস্বীকৃতি জানায়। এখন, ট্রাম্প প্রশাসনের এই নতুন পদক্ষেপ ইরানের সঙ্গে সম্ভাব্য সমঝোতার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
কূটনৈতিক গুরুত্ব
জাতীয় ইরানি আমেরিকান কাউন্সিলের নীতি পরিচালক রায়ান কস্টেলো বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে আলোচনার মধ্যস্থতা এখন অত্যন্ত জরুরি। দুই দেশের বর্তমান সম্পর্ক যুদ্ধ ও পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তারের ঝুঁকির দিকে এগোচ্ছে।
রাশিয়া অতীতেও যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্কের বিভিন্ন ইস্যুতে মধ্যস্থতা করেছে, বিশেষ করে ওবামা ও বাইডেন প্রশাসনের সময়।
কস্টেলো বলেন, এমন সুযোগ খুবই স্বল্পস্থায়ী হয়। তাই দুই দেশকে এই মুহূর্তটি কাজে লাগাতে হবে, যাতে সংঘাতের দিকে পরিস্থিতি না গড়ায়।
রাশিয়া-ইরান সামরিক ও কৌশলগত সম্পর্ক
ট্রাম্পের রাশিয়াকে মধ্যস্থতা করতে আহ্বান জানানোর অন্যতম কারণ হলো মস্কো ও তেহরানের ঘনিষ্ঠ সামরিক ও কৌশলগত সম্পর্ক। জানুয়ারিতে দুই দেশ ২০ বছর মেয়াদি কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি, জ্বালানি ও বাণিজ্যের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেয়।
এই চুক্তি অনুযায়ী, রাশিয়া ও ইরান সামরিক ও নিরাপত্তা ইস্যুতে একে অপরের সঙ্গে পরামর্শ করবে এবং যৌথ সামরিক মহড়া পরিচালনা করবে। উভয় দেশ একে অপরের ভূখণ্ডকে শত্রুতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ব্যবহার করতে দেবে না।
ইউক্রেন যুদ্ধের পর রাশিয়া ইরান, চীন এবং উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করেছে।
প্রতিবেদন প্রকাশের সময় পর্যন্ত হোয়াইট হাউস এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
মন্তব্য করুন